রাঙ্গামাটি
লেক, পাহাড়, ঝরণা প্রকৃতির কন্যা রাঙ্গামাটি। রূপময়ী বাংলা যেন রূপের রাণী হয়েছে রাঙ্গামাটির অপরূপ সৌন্দর্যের রাজমুকুটটি ধারন করেই। চারপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়ের দৃঢ়তার সাথে লেকের জলের বহমান স্নিগ্ধতা যেন স্রষ্টার সৃষ্টির অপরূপ ঐকতান। বিরাজিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে ১১ টি ভিন্ন সম্প্রদায়ের সম্প্রীতিপূর্ণ সহাবস্থান বিশেষ মনোযোগের দাবীদার। সম্প্রদায়গুলোর পৃথক পৃথক পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা ও সংস্কৃতি দ্বারা এ জেলাটি বিশেষায়িত। নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি এই রাঙ্গামাটি জেলা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগ এর অন্তর্গত একটি প্রশাসনিক অঞ্চল।
কাপ্তাই লেকের বুকে ভেসে থাকা জেলা শহরটি আর আশপাশে সর্বত্রই রয়েছে অসংখ্য বৈচিত্র্যময় স্থান। এখানকার জায়গাগুলো বছরের বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে সাজে। রাঙ্গামাটির দক্ষিণে বান্দরবান জেলা, পশ্চিমে চট্টগ্রাম জেলা ও খাগড়াছড়ি জেলা, উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশ এবং পূর্বে ভারতের মিজোরাম প্রদেশ ও মায়ানমারের চিন প্রদেশ অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের একমাত্র জেলা, যার সাথে ভারত ও মায়ানমার দুটি দেশেরই আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে।
রাঙ্গামাটি দেশের এক মাত্র রিক্সা বিহীন শহর, হ্রদ পরিবেষ্টিত পর্যটন শহর এলাকা। এ জেলায় চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, মুরং, বোম, খুমি, খেয়াং, চাক্, পাংখোয়া, লুসাই, সুজেসাওতাল, রাখাইন সর্বোপরি বাঙ্গালীসহ ১৪টি জনগোষ্ঠি বসবাস করে। বিজু, সংগ্রাই, বৈসুক উৎসব, হাল পালানী উৎসব, পুন্দা পুজা, পালাগান, পাহাড়ি লোকগীতি, গীতি নৃত্য নাট্য, গরাইয়া নৃত্য, জুম নৃত্য, বাঁশ নৃত্য, বোতল নৃত্য লোকসংস্কৃতি হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের বৃহত্তম জেলা রাঙ্গামাটির মোট আয়তন ৬১১৬.১৩ বর্গ কিলোমিটার। মোট জনসংখ্যা ৬,২০,২১৪ জন (২০১১ সালের পরিসংখ্যান)। রাঙ্গামাটি জেলা ১০টি উপজেলা, ১২টি থানা, ২টি পৌরসভা, ৫০টি ইউনিয়ন, ১৫৯টি মৌজা, ১৩৪৭টি গ্রাম ও ১টি সংসদীয় আসন নিয়ে গঠিত। উপজেলা ১০ টি হলো- রাঙ্গামাটি সদর, নানিয়ারচর, লংগদু, বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, রাজস্থলী, কাপ্তাই, কাউখালী।
রাজধানী ঢাকা থেকে এ জেলার দূরত্ব প্রায় ৩০৮ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম বিভাগীয় সদর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার। কর্ণফুলি, কাসালং, চেঙ্গী ও মাইনী নদী এবং কাপ্তাই হ্রদ উল্লেখযোগ্য জেলার প্রদান নদ-নদী। প্রশাসন ১৯৮৩ সালে রাঙ্গামাটি মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়।
দর্শনীয় স্থান
- আসামবস্তি ব্রীজ
- উপজাতীয় জাদুঘর
- ওয়াজ্ঞা চা এস্টেট
- কর্ণফুলি কাগজ কল
- কংলাক পাহাড়
- কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান
- কাপ্তাই বাঁধ ও কর্ণফুলি পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র
- কাপ্তাই সেনানিবাস
- কাপ্তাই হ্রদ
- চিৎমরম বৌদ্ধ বিহার
- চিং হ্লা মং চৌধুরী মারি স্টেডিয়াম
- ঝুলন্ত সেতু
- টুকটুক ইকো ভিলেজ
- ডলুছড়ি জেতবন বিহার
- তবলছড়ি আনন্দ বিহার
- দুমলং
- ধুপপানি ঝর্ণা
- নৌ বাহিনীর পিকনিক স্পট
- পাবলাখালী বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য
- পেদা টিং টিং
- প্যানোরমা জুম রেস্তোরা
- বনশ্রী পর্যটন কমপ্লেক্স
- বাংলাদেশ সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট
- বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ স্মৃতি ভাস্কর্য
- বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র
- মুপ্পোছড়া ঝর্ণা
- যমচুগ বন বিহার
- রাঙ্গামাটি সেনানিবাস
- রাজবন বিহার
- রাজা জং বসাক খানের দীঘি ও মসজিদ
- রাজা হরিশ চন্দ্র রায়ের আবাসস্থলের ধ্বংসাবশেষ
- লাভ পয়েন্ট
- শহীদ শুক্কুর স্টেডিয়াম
- শুভলং ঝর্ণা
- সাজেক ভ্যালি
- হাজাছড়া ঝর্ণা
- ঝুলন্ত সেতু: পর্যটকদের বিনোদনের জন্য পর্যটন কর্পোরেশনের উদ্যোগে রাঙামাটিতে ১৯৮৫ সালে নির্মাণ করা হয়েছ। এ সেতুটিকে রাঙামাটির প্রতীক’ বলা হয়। সেতুটির জন্য দেশ এবং দেশের বাইরে আলাদা পরিচিতি পেয়েছে রাঙামাটি।
- ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাদুঘর: শহরের ভেদভেদী এলাকায় গড়ে তুলেছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাদুঘর।
- রাঙামাটি মিনি চিড়িয়াখানা: শহরের রাঙাপানি এলাকায় প্রকৃতির অপরূপ পরিবেশে জেলা পরিষদের অর্থায়নে গড়ে উঠেছে মিনি চিড়িয়াখানা। বানর, ভাল্লুক, অজগর, সজারু, হরিণ বনমোরগসহ অনেক প্রাণী রয়েছে এ চিড়িয়াখানায়।
- বনভান্তের বৌদ্ধ মন্দির: শহরের রাজবাড়ি এলাকায় দক্ষিণ এশিয়ার বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের অন্যতম তীর্থ স্থান বনভান্তের বৌদ্ধ মন্দিরটিও ঘুরে দেখতে পারেন পর্যটকরা। বিশাল আকৃতির মূর্তি, প্রাকৃতিক পরিবেশ আপনাকে আলাদা শান্তি প্রদান করবে।
- রাঙামাটি-কাপ্তাই সংযোগ সড়ক: রাঙামাটি-কাপ্তাই যোগাযোগের জন্য রাঙামাটি শহরের আসামবস্তি-রাঙাপানি সড়কের কাছে একটি বিকল্প সড়ক রয়েছে। বর্তমানে এ সড়কটি এখন পর্যটক বান্ধব সড়কে পরিণত হয়েছে।
- রাঙ্গামাটি স্টেডিয়াম
কৃতী ব্যক্তিত্ব
- ঊষাতন তালুকদার –– উপজাতি নেতা ও রাজনীতিবিদ।
- কনক চাঁপা চাকমা –– চাকমা শিল্পী।
- কল্প রঞ্জন চাকমা –– প্রাক্তন সংসদ সদস্য ও প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী।[২০]
- কামিনী মোহন দেওয়ান –– পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সর্বপ্রথম প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্য।[২০]
- চাইথোয়াই রোয়াজা –– প্রাক্তন সংসদ সদস্য।[২০]
- দীপংকর তালুকদার –– রাজনীতিবিদ।
- দেবশিস রায় –– রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকার কর্মী।
- পারিজাত কুসুম চাকমা –– প্রাক্তন সংসদ সদস্য।[২০]
- ফিরোজা বেগম চিনু –– রাজনীতিবিদ।
- বিনয় কুমার চাকমা –– প্রাক্তন সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী।[২০]
- বিনীতা রয় –– কথা সাহিত্যিক।[২০]
- মনি স্বপন দেওয়ান –– রাজনীতিবিদ।
- মমতাজ বেগম –– রাজনীতিবিদ।
- মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা –– উপজাতি নেতা ও রাজনীতিবিদ।
- সন্তু লারমা ––পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপজাতিদের একাংশের নেতা।
- সুদীপ্তা দেওয়ান –– রাজনীতিবিদ ও পুরস্কার প্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী সমাজকর্মী।
- সুবিমল দেওয়ান –– জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী সমাজকর্মী।
যাতায়াত
সড়ক পথে- রাজধানী ঢাকার সায়েদাবাদ, কলাবাগান, ফকিরাপুল অথবা গাবতলি থেকে শ্যামলী, হানিফ, ইউনিক, এস আলম এবং বিআরটিসি বাসে করে যেতে পারবেন রাঙামাটি। তবে সব থেকে ভালো হবে সায়েদাবাদ থেকে টিকিট করলে। নন এসি বাস ৬২০ টাকা । এসি বাস আছে শ্যামলী এবং বিআরটিসির ভাড়া ৯০০-১০০০ টাকা। সাধারণত সকাল ৮ টা, ৯ টা এবং ১০ টায় প্রতিটি কোম্পানির ২ টা করে বাস ছাড়ে। আবার রাতে ৮ টা থেকে ১০ টার মধ্যে প্রতি কোম্পানির দুইটা করে বাস ছাড়ে।
চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটিতে বাস যোগে আসা যায়। রাঙ্গামাটিতে যাওয়ার সরাসরি দুইটি বাস আছে। একটি হলো পাহাড়িকা যা চট্টগ্রাম থেকে সকাল ৮.০০টা থেকে রাত ৮.০০টা পর্যন্ত এবং রাঙ্গামাটি হতে সকাল ৮.০০টা থেকে রাত ৮.৩০মিনিট পর্যন্ত চলাচল করে। এই বাস সার্ভিসটি প্রতি ১ ঘন্টা অন্তর অন্তর স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় এবং গন্তব্যে পৌঁছাতে প্রায় ৩ ঘন্টা সময় নেয়। পাহাড়িকা বাস সার্ভিসের টিকিটের মূল্য ১৫০ টাকা এবং টিকিট মুরাদপুর ও অক্সিজেন মোড় থেকে সংগ্রহ করা যায়। আরেকটি বাস সার্ভিস হচ্ছে বিআরটিসি বাস সার্ভিস, যা রাঙামাটির একমাত্র শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস সার্ভিস। এই বাসের টিকিটের ভাড়া ১৫০ টাকা এবং টিকিট চট্টগ্রামস্থ বটতলী রেলওয়ে স্টেশনের বিআরটিসি কাউন্টার থেকে সংগ্রহ করা যাবে। এছাড়া অনেক ধরনের লোকাল বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা রয়েছে, তবে সেসব বাস সার্ভিস রাস্তার যেকোন জায়গা থেকে যাত্রী উঠানামা করায়, ফলে বাসে সবসময় যাত্রীদের ভীড় লেগে থাকে এবং গন্তব্যে ৪-৫ ঘন্টা সময় ব্যয় হয়।
রাত্রিযাপন
রাঙামাটি শহরে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। রাঙামাটি শহরের পুরাতন বাস স্ট্যন্ড ও রিজার্ভ বাজার এলাকায় লেকের কাছাকাছি হোটেলে উঠলে হোটেল থেকে কাপ্তাই লেকের পরিবেশ ও শান্ত বাতাস উপভোগ করা যাবে। এছাড়া কম খরচে থাকতে বোডিং এ থাকা যাবে। বোডিংগুলোতে খরচ কম হলেও এগুলোর পরিবেশ খুব একটা ভাল নয়। রাঙামাটি শহরের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হোটেল:
- হোটেল গ্রিন ক্যাসেল : রিজার্ভ বাজারে অবস্থিত এ হোটেলে নন-এসি সিঙ্গেল বেড, ডাবল বেড ও ত্রিপল বেডের রুমের ভাড়া যথাক্রমে ৮০০, ১০০০ ও ১২০০ টাকা। এসি কাপল বেড রুম ভাড়া ১৬০০ টাকা ও এসি ট্রিপল বেড রুম ভাড়া ২০০০ টাকা। যোগাযোগ: 01726-511532 , 01815-459146
- পর্যটন মোটেল : রাঙ্গামাটি ঝুলন্ত ব্রিজের পাশে অবস্থিত এ হোটেলটিতে নন-এসি ডাবল বেডের রুম ভাড়া ১০০০-১২০০ টাকা। আর এসি ডাবল বেড ভাড়া ১৫০০-১৮০০ টাকা। যোগাযোগঃ ০৩৫১-৬৩১২৬
- রংধনু গেস্ট হাউজ : এই গেস্ট হাউজে ফ্যামিলি বেড বা কাপল বেড ভাড়া নিতে খরচ পড়বে যথাক্রমে ৬৫০ ও ৫০০ টাকা। যোগাযোগ: 01816-712622 , 01712-392430
- হোটেল সুফিয়া : ফিসারী ঘাট, কাঁঠালতলী। যোগাযোগ: 01553-409149
- হোটেল আল-মোবা : নতুন বাস স্টেশন, রিজার্ভ বাজার। যোগাযোগ: 01811-911158
খাবার
রাঙ্গামাটিতে বিভিন্ন মানের খাবার রেস্টুরেন্ট রয়েছে। রেস্টুরেন্টে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী বাঙালী, পাহাড়ি সব খাবার পাওয়া যায়। ভিন্ন স্বাদের এইসব খাবারের স্বাদ নিতে পর্যটকগণ আগ্রহী থাকেন।
Leave a Reply