সোনাদিয়া দ্বীপ
সুন্দরবন, নিঝুম দ্বীপ, সেন্টমার্টিন এসবের বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত দ্বীপ সোনাদিয়া। পর্যটন নগরী কক্সবাজার জেলার মহেশখালি উপজেলার ৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট সোনাদিয়া দ্বীপ (Sonadia Island) ক্যাম্পিং করার জন্য আদর্শ জায়গা। একটি খাল সোনাদিয়া দ্বীপকে মহেশখালি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এ দ্বীপের ৩ দিক থেকে আছে সমুদ্র সৈকত, আছে জীব বৈচিত্রের পরিপূর্ণ জলাবন, ছোট বড় খালের সমন্বয়ে প্যারাবন, সাগর লতায় ঢাকা বালিয়াড়ি এবং বিচিত্র প্রজাতির জলচর পাখি। জীববৈচিত্রের অপূর্ব সমন্বয় দেখতে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক সোনাদিয়া দ্বীপে ভীড় জমায়।
যান্ত্রিকতা ছেড়ে যারা একটু নিভৃতে সময় উপভোগ করতে চান, সমুদ্রের বিশালতায় নিজেকে হারিয়ে খুঁজতে চান কিংবা ক্যাম্পিং করতে চান তাদের জন্য আদর্শ জায়গা এই সোনাদিয়া। বন্ধুরা মিলে তাবু নিয়ে কয়েকদিনের জন্য ছুটে যেতে পারেন নির্জন এই দ্বীপে। বিশেষ করে চাঁদনী রাতে সোনাদিয়া সৈকতে একটা রাত ক্যাম্পিং করলে বুঝতে পারবেন পৃথিবী কত সুন্দর!
অবস্থান
সোনাদিয়া দ্বীপ বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার অর্ন্তগত কুতুবজোম ইউনিয়নে অবস্থিত। কক্সবাজার জেলা শহর থেকে দূরত্ব প্রায় ১৫ কিমি উত্তর-পশ্চিমে। এটি জীববৈচিত্রের দ্বীপ ও প্যারাদ্বীপ নামে পরিচিত। এটি মহেশখালী কেনেল দ্বারা কক্সবাজারের মূল ভূখন্ড থেকে বিছিন্ন হয়েছে। এই দ্বীপটি বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরির জন্য নির্বাচিত হয়েছে।
মহেশখালী থেকে সোনাদিয়া দ্বীপ যাওয়ার পথের সবকিছুই মনে হবে শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোনো এক অকৃত্রিম ছবি চোখের সামনে ভাসছে। এ দৃশ্য যেনো কোনোদিন ভোলার নয়। এখানকার খালের পানি এতই স্বচ্ছ ও টলটলে দেখে মনে হবে যেনো কোনো কাচের উপর দিয়ে নৌযানটি এগিয়ে চলেছে। যা দেখলে শত বছরের দু:খ-কষ্ট এক নিমেষেই ভুলে যেতে বাধ্য। সমুদ্র থেকে সৃষ্টি হয়ে ভিতরের দিকে গিয়ে খালটি কয়েকটি শাখা প্রশাখায় ছড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। খালের দু-পাশে সবুজ বন। এসব বনে রয়েছে কেওড়া, হারগোজা, উড়িঘাস এবং কালো ও সাদা বাইন বৃক্ষ।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপটির মতো এই দ্বীপটি সমুদ্রের বুকে অবস্থিত হলেও সেন্টমার্টিন দ্বীপের মতো এখানে তেমন জনবসতি এখনো গড়ে উঠেনি। মূলত এই দ্বীপের বেশিরভাগ লোকই জেলে এবং সামান্য পরিমাণে কিছু লবণ চাষীও রয়েছে। অন্যভাবে বলা যায় জীবনযাত্রার মান খুব ভালো নয় বিধায় এখানে জনবসতি গড়ে উঠছে না। কেননা এখানে কোনো হাট-বাজার নেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের বাজার-সদাইয়ের জন্য একমাত্র ভরসা ছোট ছোট মুদির দোকানগুলো। এই দ্বীপের যে বিষয়টি পর্যটকদের মনে সারাজীবন স্থান করে সক্ষম সেটি হলো এখানকার চা। অত্যন্ত সাধারণ মানের হলেও এখানকার চায়ের স্বাদ কখনো ভুলবার নয়।
দ্বীপটির শেষপ্রান্ত পশ্চিম দিকে বেশ খোলামেলা। এই স্থানটিতে কোনো জনবসতি নেই। সবুজ ঘাসের কার্পেটে মোড়ানো খোলা মাঠ, নির্জনতা ও অফুরন্ত বাতাস সব মিলিয়ে মন প্রশান্তিতে ভরে যায়। এই দ্বীপটির প্রতিটি পরতে পরতে দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে অসংখ্য মুগ্ধতা। এই দ্বীপের খোলা মাঠে বসলে মনে হবে যেনো অজানা-অচেনা কোনো দ্বীপে আপনি একা। আপনার পাশে কেউ বসে থাকলেও মনে হবে আপনি একা চারপাশে লাল কাঁকড়ার ছুটাছুটি। সবকিছুই মনে হবে সিনেমার দৃশ্যের মতো। অনেকের মতে সেন্ট মার্টিনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের চেয়ে সোনাদ্বিয়া দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেক এগিয়ে। এই দ্বীপের কিছু অংশে তরমুজের চাষ করা হয়। তরমুজের মৌসুমে গেলে এখানকার তরমুজের স্বাদ বাড়তি পাওনা।
পর্যটকদের জন্য সোনাদ্বিয়া দ্বীপে একটি বেসরকারী সামুদ্রিক কচ্ছপের হ্যাচারি রয়েছে। দ্বীপ থেকে কচ্ছপের ডিম সংগ্রহ করে সেগুলো এখানে সংরক্ষণ করে তারপর সেসব ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়া হয়।
যাতায়াত ব্যবস্থা
সোনাদিয়া দ্বীপে যেতে দেশের যেকোনো স্থান থেকে নিজের পছন্দমত যানবাহনে করে প্রথমে কক্সবাজার আসতে হবে। কক্সবাজার কস্তুরী ঘাট বা ৬ নং জেটি ঘাট থেকে জনপ্রতি ৮০ টাকা ভাড়ায় স্পিডবোট করে মহেশখালী যাওয়ার জন্যে স্পীড বোট পাবেন, মহশখালি পৌঁছাতে সময় লাগবে ২০-২৫ মিনিট। মহেশখালী ঘাট থেকে ২০ থেকে ২৫ টাকা ভাড়ায় রিক্সায় গোরকঘাটা বাজারে যেতে হবে আর সেখান থেকে যেতে হবে ঘটিভাঙ্গায়। গোরকঘাটা থেকে সিএনজিতে ২৪ কিলোমিটার দূরত্বের ঘটিভাঙায় যেতে ভাড়া লাগবে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা।
ঘটিভাঙ্গা থেকে সোনাদিয়া দ্বীপে যেতে হয় ইঞ্জিন চালিত নৌকায়। ঘটিভাঙ্গা থেকে খেয়া নৌকায় সোনাদিয়া চ্যানেল পার হলেই সোনাদিয়া দ্বীপ। প্রতিদিন জোয়ারের সময় পশ্চিম সোনাদিয়া থেকে ঘটিভাঙা পর্যন্ত মাত্র একবার একটি ট্রলার ছেড়ে আসে। আর এই ট্রলারটিই কিছুক্ষণের মধ্যে যাত্রীদের তুলে নিয়ে আবার ফিরতি যাত্রা করে, প্রতিজন ভাড়া লাগে ২৫ টাকা। বিশেষ ভাবে মনে রাখবেন ঘটিভাঙ্গা থেকে সোনাদিয়া পশ্চিম পাড়ার উদ্দেশ্যে প্রতিদিন শুধু একটি মাত্র বোট যায় আর সেটা জোয়ার ভাঁটার সময়ের উপর নির্ভর করে চলাচল করে। তবে এই সময় সকাল ১০ টা বা এর আশে পাশেই হয়।
ঘটিভাঙ্গা থেকে পায়ে হেটে সোনাদিয়া দ্বীপের পূর্ব পাড়ায় যাওয়া যায় তবে সেটা একটু কষ্টকর সেই সাথে পূর্ব পাড়ায় এখনো পর্যটকদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নেই তাই পশ্চিম পাড়া দিয়েই যাতায়াত করা ভাল।
উল্লেখ্য কক্সবাজার থেকেও সরাসরি স্পীডবোট রিজার্ভ করে সোনাদিয়া দ্বীপে যাওযার ব্যবস্থা রয়েছে। সেজন্য নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত টাকা গুণতে হবে। যারা সমুদ্রপথে অ্যাডভেঞ্চার ফিল নিতে চান তাঁরা কিছু বাড়তি খরচ করে কক্সবাজার থেকে সরাসরি স্পীড বোটে করে সোনাদিয়া দ্বীপে যেতে পারেন।
সড়কপথে মহেশখালীঃ সরাসরি গাড়িতে করে মহেশখালী যাওয়া যায়। যারা ভোটে চড়তে ভয় পান বলে স্থলপথে আসতে চান বা প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে যেতে চান তাদেরকে কক্সবাজার থেকে বা ঢাকা/চট্টগ্রাম থেকে আসার পথে চকরিয়া নামতে হবে। চকরিয়া থেকে জীপ/সিএনজিতে করে বদরখালি এবং তারপর জীপ/সিএনজিতে করে গোরকঘাটা বাজারে যেতে হবে।
থাকা-খাওয়া
সোনাদিয়া দ্বীপে পর্যটকদের থাকার জন্য কোনো আবাসিক হোটেল নেই। খাওয়ারও তেমন কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই। স্থানীয় লোকজনকে টাকা দিলে তারা খাওয়ার ব্যবস্থা করে থাকে। আর সোনাদিয়া দ্বীপে রাত্রি যাপনের ক্ষেত্রেও ভরসা সেই স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে রাতে থাকার কষ্টের কথা চিন্তা করে যারা সূর্যোদয়ের আগেই ফিরে আসবেন তারা সোনাদিয়া দ্বীপের আসল সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হবেন। এখানকার সূর্যাস্ত আরও অসাধারন। সন্ধ্যায় সাদা পালক দুলিয়ে সারি সারি বক উড়ে যায় আপন ঠিকানায়। নীল আকাশের কপালে কে যেন দেয় লাল টিপ। আস্তে আস্তে যখন সূর্য হারিয়ে যায় সাগরের বুকে তৈরি হয় এক মোহনীয় পরিবেশ। এখানে রাত্রিযাপন হতে পারে আপনার জীবনের সেরা রাতের একটি।
পরামর্শ
সোনাদিয়া ভ্রমণে আপনার হাতে একদিন সময় বেশি নিয়ে ঘুরে আসুন সোনাদিয়ার পাশাপাশি মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, রাখাইন পাড়া, বৌদ্ধমন্দির, চরপাড়া, লবণের মাঠ, পানের বরজ। রিক্সায় উঠার আগে আশেপাশের স্থানীয় কারো কাছ থেকে ভাড়াটা জেনে নিবেন, তারপর দরদাম করে উঠবেন, নয়তো কিছু কিছু রিকশাওয়ালা খুব ঝামেলা করে।
তথ্য সহযোগিতার প্রয়োজনে যোগাযোগঃ মুহাম্মদ আলাউদ্দিন ছাবের, উদ্যোক্তা, কুতুবজোম ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, মহেশখালী, কক্সবাজার। 01740817372
Leave a Reply